বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব
ভূমিকা : ইতিহাসের আলোচনায় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বারা হল ‘বিদ্রোহ’, ‘অভ্যুত্থান’ ও ‘বিপ্লব’। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শোষক ও অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। এই প্রতিবাদ বা ক্ষোভের প্রকাশ বিভিন্ন ‘বিদ্রোহ’ বা ‘অভ্যুত্থান’ বা ‘বিপ্লব’-এর মাধ্যমে হতে পারে। ‘বিদ্রোহ’, ‘অভ্যুত্থান’ ও ‘বিপ্লব’-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যেমন—

[1] বিদ্রোহ :
i. বিদ্রোহ কী? : বিদ্রোহ বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনসমষ্টির আন্দোলন। বিদ্রোহ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন সম্ভব।
ii. উদাহরণ : ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিদ্রোহের গতি অনেক সময় থেমে যায়। যেমন, রংপুর বিদ্রোহের মতো ঘটনায় আগে প্রচলিত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আবার নীল বিদ্রোহের পর সরকার নীল কমিশন নিয়োগ করে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার লাঘবের ব্যবস্থা করে।
[2] অভ্যুত্থান :
i. অভ্যুত্থান কী? : অভ্যুত্থান বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। অভ্যুত্থান দীর্ঘমেয়াদী হয় না। অভ্যুত্থান সাধারণত খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। অভ্যুত্থানে বিরোধী গোষ্ঠীর ভূমিকা থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তবে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি ‘অভ্যুত্থান’-এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ii. উদাহরণ : [i] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ সংঘটিত করে। [ii] ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নৌসেনাদের নৌবিদ্রোহ সম্পন্ন হয়। [iii] স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপতি মহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। এগুলি অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
[3] বিপ্লব :
i. ‘বিপ্লব’ কী? : ‘বিপ্লব' বলতে বোঝায় প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন। ‘বিপ্লব’ হল ‘বিদ্রোহ’ এবং ‘অভ্যুত্থান’-এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। ii. উদাহরণ: [a] অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইউরোপের শিল্পব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। [b] ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সের পূর্বতন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে। বিদ্রোহকে আবার বিপ্লবের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়।
উপসংহার : ‘বিদ্রোহ’, ‘অভ্যুত্থান’ ও ‘বিপ্লব’- এই তিনটি বিষয়কে অনেক সময়ই সুস্পষ্টভাবে পৃথক করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, একই গণবিক্ষোভ বা আন্দোলনকে কেউ কেউ ‘অভ্যুত্থান’ আবার কেউ কেউ ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে–[1] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে কেউ কেউ ‘বিদ্রোহ’, ‘আবার কেউ কেউ ‘অভ্যুত্থান' হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। [2] ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেউ কেউ ‘গণবিদ্রোহ’ আবার কেউ কেউ ‘গণ অভ্যুত্থান' বলে বর্ণনা করে থাকেন।