
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব —
ভূমিকা : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে ভারতের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। উনিশ শতকের শুরুতে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে ভারতে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা উচিত সেবিষয়ে সরকারকে চিন্তাভাবনা শুরু করতে হয়। এদেশে সরকারের প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগে নেওয়া উচিত সেবিষয়ে একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয় যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।
[1] দ্বন্দ্বের সূত্রপাত : ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইন পাস করে প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ভারতীয়দের জনশিক্ষার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুসারে জনশিক্ষা কমিটি বা কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রামমোহন রায় সরকারকে লেখা এক পত্রের দ্বারা সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের দাবি জানান। এভাবে এদেশে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত সেবিষয়ে একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
[2] জনশিক্ষা কমিটিতে বিভেদ : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) তাঁর আইন সচিব ব্যাবিংটন মেকলে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। এদেশে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিত—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা কার্যত প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট এবং পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে সরকারি শিক্ষানীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
[3] প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী : [1] প্রাচ্যবাদের সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ। প্রাচ্যবাদীরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য বা দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। [2] পাশ্চাত্যবাদের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ। পাশ্চাত্যবাদীরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান।
[4] মেকলের প্রস্তাব : উগ্র পাশ্চাত্যবাদী মেকলে বলেন যে, “ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ।” তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের (২ ফেব্রুয়ারি) বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব (Minutes) দেন যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।
[5] মেকলে মিনিটের বক্তব্য : মেকলে তাঁর ‘মিনিট’ বা প্রস্তাবে বলেন যে– [1] প্রাচ্যের শিক্ষা বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় সম্পূর্ণ নিকৃষ্ট। [2] প্রাচ্যের সভ্যতা দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপবিত্র। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। [3] এদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে ক্রমনিম্ন পরিসুত নীতি বা চুঁইয়ে পড়া নীতি (Downward Filtration Theory) অনুসারে তা ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। [4] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা “রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”
উপসংহার : ভারতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হন। বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের (৭ মার্চ) পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং এদেশে দ্রুত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।